জহির রায়হান—দেশের সবচেয়ে মেধাবী নির্মাতা-লেখকদের একজন। জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। সিনেমা জগতে তাঁর প্রথম পদার্পণ ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নামের এক উর্দু সিনেমাতে সহকারী পরিচালক হিসেবে। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬১ সালে তাঁর সিনেমা ‘কখনো আসেনি’র মাধ্যমে।
১৯৬৪ সালে তিনি তৈরি করেন উপমহাদেশের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’। একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর রচিত কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। এ ছাড়াও বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক ও তথ্যচিত্র মিলিয়ে তিনি সর্বমোট ১২টি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। তাঁর বানানো ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্র দিয়ে নায়করাজ ‘রাজ্জাক’ বড় পর্দায় বেশ জনপ্রিয় হন।
এ ছাড়া ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তাঁকে এতটাই অনুপ্রাণিত করে যে, তিনি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৭০ সালে নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেওয়া’। যে সিনেমা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তখনকার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাসহ আরও অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে তাঁর ‘স্টপ জেনোসাইড’কে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয়। তবে মেধাবী এ মানুষটি দেশ স্বাধীনের ঠিক পরপরই হারিয়ে যান।
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে দেশ হয় স্বাধীন। ১৯৭২’র ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামে এক অজ্ঞাত টেলিফোন কল আসে জহির রায়হানের বাসায়। টেলিফোনে তাঁকে জানানো হয়েছিল, তাঁর বড় ভাই অর্থাৎ শহীদুল্লাহ কায়সার বন্দি আছেন মিরপুর-১২ নম্বরে। ভাইকে বাঁচাতে হলে যেতে হবে তাঁকে মিরপুরে। সেদিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টেলিফোন পেয়ে তিনি দুটো গাড়ি নিয়ে মিরপুরে রওনা দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই জাকারিয়া হাবীব ও আরও কয়েকজন।
মিরপুর-২ নম্বর সেকশনে পৌঁছানোর পর সেখানে তাঁকে সেনাবাহিনী ও পুলিশি বাধা দেওয়া হয়। তাঁর ছোট ভাই হাবীবের ভাষ্যমতে, তিনি জহির রায়হানকে মিরপুর পুলিশ স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।
আরেকটি তথ্য বলছে, মিরপুর-১২ নম্বর ‘ডি’ ব্লকের মুসলিম বাজার ঢালের পশ্চিমে ওয়াসার পানির ট্যাংকের সামনে তাঁকে হত্যা করা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রকাশিত মিরাজ মিজু রচিত ‘মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি’ শীর্ষক পুস্তিকা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ওই সূত্র মতে, ১২ নম্বর পানির ট্যাংক থেকেই টেনেহিঁচড়ে তাঁর লাশ নিয়ে গুম করে ফেলা হয়। বিহারিদের সঙ্গে সে সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
জহির রায়হানকে হত্যার পরদিন ৩১ জানুয়ারি মিরপুর মূলত বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলমুক্ত হয়।